আমরুল শাকের যত পুষ্টিগুণ সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
প্রিয় পাঠক, আপনি কি আমরুল শাককে আগাছা মনে করে অগ্রাহ্য করছেন? তাহলে আপনি জেনে নিন আমরুল শাকের ভেষজ গুনাগুন। এই আর্টিকেলে আমরা আমরুল শাকের ভেষজ গুনাগুন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাই এ সম্পর্কে জানতে সম্পন্ন আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
এছাড়াও এই আর্টিকেল পড়ার মাধ্যমে আপনি আমরুল পাতা খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। আমরুল পাতার রস বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী। তাই এ সমস্ত কিছু জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন।
ভূমিকা
আমরুল একটি ছোট সরু লতানো উদ্ভিদ। এটি সাধারণত আম অর্থাৎ আমাশয় রোগকে রুকে দেয় অর্থাৎ প্রতিহত করে বলে এই শাকের নাম প্রথমে আমরুক ছিল। পরে এটি পরিবর্তিত হয়ে আমরুল নামকরণ করা হয়েছে। এটি সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ভালো জন্মায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে এটি বেশি দেখা গেলেও সারা বছর এই শাক পাওয়া যায়।
এই শাক দেখতে অনেকটা শুশুনি শাকের মত। কিন্তু পার্থক্য হলো শুশনি শাকের চারটি পাতা থাকে কিন্তু আমরুল শাকের তিনটি পাতা থাকে। সেই সাথে এর পাতা দেখতে অনেকটা হার্ট আকৃতির। আমরুল শাকের প্রায় ২০০ টি প্রজাতি থাকলেও বাংলাদেশে হলুদ ও গোলাপি ফুলের আমরুল শাক বেশি দেখা যায়। আমরুল শাক খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি এর রয়েছে নানা ঔষধি গুণ।
তবে দীর্ঘদিন এটি গ্রহণ করলে শরীরের দ্বারা ক্যালসিয়াম শোষণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এই শাকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকার কারণে এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এই আর্টিকেলে আমরা আমরুল শাকের ভেষজ গুনাগুন নিয়ে আলোচনা করব। তাহলে চলুন আলোচনা শুরু করা যাক।
আমরুল শাক কোথায় পাওয়া যায়
আমরুল শাক আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি শাক। কিন্তু এদেশের গ্রাম বাংলার মানুষ একে আগাছা হিসেবেই বেশি চিনে। বাংলাদেশের সকল জায়গায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এই শাক বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
এই গাছ সাধারণত রাস্তার আশেপাশে, বাড়ির আশেপাশে, যে কোন ঝোপ ঝারে বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে বর্ষাকালে এই শাক বেশি জন্মে। এই শাক সাধারনত স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এই শাকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকার কারণে অনেকে একে রান্না করে খায় আবার অনেকে একে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে।
এলাকা ভেদে এই শাককে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। এই শাক চুকা শাক, টক পাতা, চ্যাংদোলা, চুকত্রিপাতিসহ নানা নামে পরিচিত। পৃথিবীতে প্রায় ২০০ প্রজাতির আমরুল শাক জন্মিলেও বাংলাদেশে হলুদ ও গোলাপি ফুলের আমরুল বেশি দেখা যায়।
আমরুল পাতা খাওয়ার নিয়ম
আমরুল শাক হলো একটি তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। এটি দেখতে অনেক সরল ও লতানো উদ্ভিদ। এটি সাধারণত মাটির উপর বিস্তৃত থাকে। সাধারণত একে শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। আবার অনেকে একে ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করেন। এর জন্য এর শুকনো পাতা পেস্ট করে নিয়ে পানি বা দুধের সাথে খেয়ে থাকেন।
আবার অনেকে আঙ্গুল কথা সিদ্ধ করে সেই পাতার রসের সাথে সামান্য চিনি মিশিয়ে সরবতের মতো খেয়ে থাকেন। এছাড়াও এই পাতা বিভিন্ন রান্নার রেসিপিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে আলাদা স্বাদ তৈরি করার জন্য। তবে এটি যেমন করে খাওয়া হোক না কেন এই শাকের ভেষজ গুনাগুন আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের উপকার সাধন করে থাকে।
আমরুল শাকের পুষ্টিগুণ
আমরুল শাক সাধারণত টক স্বাদযুক্ত হয়ে থাকে। এ কারণে এই শাক অনেকেই পছন্দ করে আবার অনেকে এর টক স্বাদের জন্য খেতে পারেনা। তবে এই শাক পুষ্টিগুনে ভরপুর। টক স্বাদযুক্ত হওয়ায় এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি বিদ্যমান। তাই এটি খাওয়ার ফলে শরীরের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ হয়।
এছাড়াও এই শাকের পাতায় রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যারোটিন ইত্যাদি খনিজ উপাদান। শুধু এর পাতা নয় এর কান্ড ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। এই শাকের কাণ্ডে রয়েছে সাইট্রিক এসিড, ম্যালিক এসিড, টারটারিক অ্যাসিড।
আমরুল শাকের উপকারিতা
আমরুল শাকের স্বাদ কিছুটা টক ধরনের হয় এটি অনেকের কাছেই অনেক প্রিয়। এছাড়াও এই শাক ভেষজ গুণসম্পন্ন হওয়ার কারণে মানুষকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এই পর্বে আমরা আমরুল শাকের উপকারিতা আলোচনা করব। সেগুলো হলো-
শিশুদের সর্দি ভালো করতে
আমরুল শাক শিশুদের সর্দি ভালো করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যদি কোন সর্দি বুকে বসে যায় এবং ঘন ঘন কাশি হয় তবে তাকে যদি আমরুল পাতার রস খাওয়ানো যায় তবে তার সর্দি কাশি দ্রুত ভালো হয়ে যায়। এছাড়াও এর পাশাপাশি সরিষার তেলের মধ্যে আমরুল পাতার রস মিশিয়ে তা উষ্ণ গরম করে বুকে ও পিঠে মালিশ করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন এক দিনে অধিক পরিমাণ আমরুল পাতার রস সেবন করা না হয়।
উচ্চ রক্তচাপ নিরাময়ে
বর্তমানে মানুষদের যে সাধারণ সমস্যাগুলো রয়েছে তার মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ একটি। অধিকাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে গেলে ঘাড়ে ব্যথা হওয়া থেকে শুরু করে মাথা ঘুরানো সহ নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আখের গুড়ের সাথে আমরুল পাতার রস মিশিয়ে শরবত বানিয়ে প্রতিদিন খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
দাঁত ও মাড়িকে ভালো রাখে
আমাদের অনেকেরই দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ে এবং মাড়ি ফুলে যায়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমরুল পাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য আপনি নিয়মিত আমরুল পাতা ব্যবহার করতে পারেন। এর জন্য আপনাকে আমরুল পাতা ভালোভাবে পেস্ট করে নিয়ে এতে লবণ ও হলুদ মিশিয়ে দাঁত ও মাড়িতে নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে। এতে করে উপকার পাবেন। এছাড়াও যাদের মুখের দুর্গন্ধ হয় তারা নিয়মিত এই পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন। এতে করে মুখের দুর্গন্ধ দূর হবে।
ভিটামিন সি এর অভাব পূরণ করে
আমরুল শাক টক স্বাদযুক্ত হওয়ার কারণে এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি বিদ্যমান। নিয়মিত এই শাক খাওয়ার ফলে শরীরে ভিটামিন সি এর অভাব পূরণ হয়।
অম্ল সমস্যা সমাধানে
আমাদের মধ্যে অনেকেই টক খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু টক খাওয়ার সাথে সাথে তাদের গ্যাসের সমস্যা হয়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আপনি নিয়মিত আমরুল পাতার রস খেতে পারেন। এটি আপনাকে অম্ল সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে। এটি অম্লতা কমিয়ে মুখের রুচি ফেরাতে সাহায্য করে।
লিভার সুস্থ রাখে
লিভার সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে আমরুল পাতা ঔষধের ন্যায় কাজ করে। তাই যাদের লিভারের সমস্যা রয়েছে তারা নিয়মিত চার-পাঁচটি আমরুল পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন। প্রতিদিন এই পাতা খাওয়ার ফলে এটি আপনার শরীরকে ডিটক্সিফাই করে ফলে লিভার সুস্থ থাকে।
মাইগ্রেনের সমস্যা সমাধানে
মাইগ্রেন এমন একটা সমস্যা যা বংশ পরম্পরায় একজন থেকে অন্য জনে স্থানান্তরিত হয়। এই রোগ একেবারে ভালো করা কখনোই সম্ভব নয়। তবে এই রোগ বিভিন্ন ভাবে দমিয়ে রাখা যায়। যারা মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত আমরুল পাতার রস ও পিয়াজের রস সমপরিমাণ নিয়ে তার কপালে ভালোভাবে ম্যাসাজ করুন। কিছুক্ষণ পর আপনি নিজেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন।
নতুন ও পুরাতন আমাশয় ভালো করতে
আমাশয় এমন একটি রোগ যা দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে। নতুন ও পুরাতন আমাশয় ভালো করতে আমরুল পাতার রস খুবই কার্যকারী। বিশেষ করে পুরাতন আমাশয় দূর করতে মাখন তোলা দুধের সাথে আমরুল পাতা সিদ্ধ করে সেই দুধ দিনে ২/৩ বার খেলে দারুন উপকার পাওয়া যায়। নিয়মিত এটি খাওয়ার ফলে দীর্ঘদিনের পুরাতন আমাশয়ও ভালো হয়ে যায়। এছাড়া এটি রক্ত আমাশয় ভালো করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
চুলকানি ও ফোঁড়া নিরাময়ে
আমাদের অনেকেরই নানা কারণে চুলকানি ও ফোঁড়া হয়ে থাকে। এই চুলকানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরুল পাতার রস গায়ে মাখা হয়। এই রস গায়ে মাখলে চুলকানি ভালো হয়। সেই সাথে যদি কারো ফোঁড়ায় যন্ত্রণা হয় তবে সে আমরুল পাতার পেস্ট তৈরি করে তা ফোঁড়ায় লাগালে যন্ত্রণা কমে যায়। এছাড়াও বিষাক্ত পোকামাকড় কামড়ালে সেই স্থানে এই পাতার রস লাগালে যন্ত্রণা কমে যায়।
মূত্রগ্রহ রোগ নিরাময়ে
আমাদের অনেকেরই প্রস্রাবের বেগ হয় কিন্তু প্রস্রাব হয় না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরুল পাতা খুবই উপকারী। নিয়মিত এই পাতার দুই চামচ রস হাফ কাপ পানিতে মিশে দৈনিক চারবার খেলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে
আমাদের অনেকেরই শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য প্রতিদিন বিকেলে এক কাপ আমরুল পাতার রস খেতে হবে। এভাবে সাত দিন খেলে শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
এছাড়াও এই শাক মুখের রুচি বাড়াতে, পেট পরিষ্কার করতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, ত্বক ভালো রাখতে, হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে, স্কার্ভি রোগ নিরাময়ের, জ্বর ভালো করতে ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি আগাছা হলেও এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। তাই আমাদের এটি খাওয়ার প্রতি যত্নবান হতে হবে।
আমরুল শাক ভাজি করার নিয়ম
আমরুল শাক গ্রাম বাংলার অতিক পরিচিত একটি শাক। এই শাকে ভিটামিন সি সহ নানা রকম পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। এইসব বিভিন্ন পদ্ধতিতে খাওয়া গেলেও বেশিরভাগ মানুষ এটি ভাজি করেই খায়। আমরুল শাক ভাজি করার জন্য প্রথমে আমরুল পাতা ভালোভাবে তুলে নিতে হবে। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে পাতাগুলোকে ধুয়ে নিতে হবে।
এরপর পাতাগুলোকে একটি পাত্রে সিদ্ধ দিতে হবে। এই সময় আপনি চাইলে স্বাদমত লবণ ব্যবহার করতে পারেন। আমরুল শাক সিদ্ধ হয়ে গেলে তা পাত্র থেকে নামিয়ে রাখতে হবে। এবার অন্য একটি পাত্র চুলায় বসিয়ে এতে পরিমাণ মতো তেল দিতে হবে। তেল কিছুটা গরম হয়ে আসার পর এতে দুইটা শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন কুচি ও কাঁচা মরিচ দিয়ে হালকা করে ভেজে নিতে হবে।
এরপর এতে সিদ্ধ করা আমরুল শাক দিয়ে দিতে হবে। আপনি চাইলে এতে সামান্য পরিমাণ হলুদ ব্যবহার করতে পারেন। এবার শাকটি ভালোভাবে ভেজে নিতে হবে। যখন শাকের পানি শুকিয়ে যাবে এরপর এটি কিছুক্ষণ ভেজে নামিয়ে নিতে হবে। তাহলেই তৈরি হয়ে গেল আমরুল শাক ভাজি। যা গরম ভাতের সাথে খেতে খুবই মজাদার।
শেষ কথা
আমরুল শাক সাধারণত বাড়ির আনাচে-কানাচে, পতিত জমিতে, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে জন্মে বলে একে আমরা তেমন গুরুত্ব দিই না। কিন্তু এই শাকের উপকারিতা অনেক। তাই আমাদের উচিত এই শাকের পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে নিয়মিত এই শাক গ্রহণ করা। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে এই শাকের বংশবিস্তার যেন বাধাগ্রস্ত না করি।
প্রিয় পাঠক, এই আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই তা কমেন্ট বক্সে জানান। এরকম আরো ইনফরমেটিভ আর্টিকেল পড়তে আমার এই ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন। পুরো আর্টিকেল মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনি আপনার মূল্যবান মন্তব্যটি এখানে লিখুন। প্রতিটি মন্তব্য গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।
comment url