পশু কোরবানির প্রস্তু্তি ও করণীয় - ইসলামের পশু কোরবানির গুরুত্ব
ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ, কোরবানির পশুকে কেন্দ্র করে মুসলমানগন পুরো দিনটাই ব্যস্ততার মধ্যে পার করে। পশু কোরবানির আগে এবং পরে অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে যা আমরা অনেকেই জানিনা, এমতবস্থায় আমরা অনেকে কোরবানির সময় অনেক ভুল করে থাকি। এই জন্য কোরবানির পশুকে কোরবানি করার আগে এবং পরের নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।
আপনি যদি শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকেন তাহলে পশু কোরবানির প্রস্তু্তি যেভাবে নেবেন - পশু জবাই করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। তাহলে চলুন আর কথা না বাড়িয়ে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ভূমিকা
কুরবানি ঈদ মানে হচ্ছে পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কোরবানির আগে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত যেমন পশু জবাই করা সরঞ্জাম, পশু জবাই করার নিয়মাবলী ইত্যাদি মেনে চলতে হয়। কোরবানি করার জন্য সর্বপ্রথম একটি সুস্থ সবল পশু ও নির্বাচন করতে হয়। সেই সাথে পশুর বয়সের দিকটাও মাথায় রাখতে হয়।
ইসলামী শরীয়তের ভাষায় কোরবানি মানে হলো জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরীয়তের বিধি-বিধান অনুসারে পশু জবাই করা। এজন্য শরীয়তে কিছু বিধি-বিধান বা নিয়মাবলী রয়েছে। আসন জেনে নিয়ে যাক কোরবানির কিছু প্রস্তুতি এবং জবাই করার নিয়ম সম্ভব সম্পর্কে।
পশু কোরবানির প্রস্তুতি যেভাবে নেবেন
প্রথমত, পশু কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত করতে হবে। পশু কাটার জন্য দা, ছুরি, এবং চাপাতি সহ অন্যান্য সরঞ্জাম গুলো ভালো করে ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোরবানির আগে পশুকে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করাতে হবে যাতে পশু জবাই করার পর চামড়া ছাড়াতে সুবিধা হয়। তবে স্যালাইন পানি পান করালে বেশি উপযোগী হবে।
জবাই করার জন্য প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে হবে। নিজে থেকে জবাই করা উত্তম। আপনি যদি নিজে জবাই করতে না পারেন তাহলে জবাই করার জন্য সঠিক বিশ্বাসের মুসলমান নির্বাচিত করতে হবে। গোস্ত বানানোর এবং জবাই করানোর পারিশ্রমিক পূর্বে নির্বাচিত করুন। এছাড়াও চাপাতি, দা, ছুরি বা চাকু, চাটাই ও খাইট্টা ইত্যাদি নির্বাচন করুন।
পশু জবাই করার পরে ময়লা আবর্জনা বা রক্তের স্তূপ জমে যায়। যার ফলে জবাইয়ের পরে জবাইয়ের স্থানটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলা আমাদের উচিত। তা না হলে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে পরিবেশ দূষণ হতে পারে। জবাই করা স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ঢেলে পরিষ্কার করে নিতে হবে।রক্ত যাতে শুকিয়ে না যায় সেদিকের লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোরবানির পরে নারিভুরি ও চামড়ার কাটা অংশ এদিক সেদিকে না রেখে একটি নির্দিষ্ট স্থানে জমা করে রাখতে হবে। এরপর পরিচ্ছন্নতা কর্মী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যদি পরিচ্ছন্নতা কর্মী না আসে তবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে হবে। এতে করে পরিবেশ দূষণ হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। অথবা পশুর রক্ত ও অন্যান্য অংশ মাটিতে ভালো হবে পুঁতে ফেলতে হবে।
কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম
- পশু জবাই করার সময় অবশ্যই বিসমিল্লাহ বলে জবাই করা। অর্থাৎ চালানো শুরু করতে হবে বিসমিল্লাহ বলে।
- পশুর খাদ্যনালী ও শ্বাস নালি দুই পাশে থাকা দুটি নালী কেটে দিতে হবে। এই বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি কারণ, এ নালীগুলো কাটা হয়ে গেলেই পশু জবাই বিশুদ্ধ হয়ে যায়।
- ছুরি বা চাকু ভালোভাবে ধার করে নিতে হবে যাতে পশু জবাই করার সময় কোনোরকম সমস্যা সৃষ্টি না হয় এবং পশুর কোন কষ্ট না হয়। কেননা ছুরিতে ধার না থাকলে পশু জবাই করার সময় পশুর অনেক কষ্ট হয়। পশু জবাই করার সময়ই যেন পশুর কোন কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- পশু জবাই করার সময় এক পশুর সামনে অন্য পশুকে জবাই পড়া উচিত নয়। পশুর সামনে চাকু ধার না করাটা উত্তম। কেননা এতে করে পশু অনেক ভয় পেয়ে যায়।
- কুরবানী করার সময় পশুকে বাম কাধে শোয়াতে হবে এবং অবশ্যই পশুর পা গুলো পশ্চিম দিকে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোরবানি ঈদে পশু চুরি হলে বা মারা গেলে করণীয়
মুসলমানদের একটি আর্থিক ইবাদতের নাম হচ্ছে কোরবানি যা আমাদের প্রতিটি সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কিন্তু কোরবানি সম্পর্কে আমাদের পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকার জন্য বিভিন্ন সময়ে আমরা অনেক ভুল ধারণাকে গুটিয়ে ফেলি। তার মধ্যে কুরবানী পশু মারা গেলে বা চুরি হয়ে গেলে করনীয় কি সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই।
যদি কোরবানির পশু চুরি হয়ে যায় বা মারা যায় এবং তার ওপর যদি কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে তাকে আরেকটি পশু ক্রয় করে কোরবানি করতে হবে। সে যদি মনে মনে চিন্তা করে যে পশু চুরি হয়ে যাওয়া বা মারা যাওয়ার কারণে তার কুরবানী হয়ে গেছে তবে তার এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। তবে যে ব্যক্তির ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয় সে ব্যক্তির আরেকটি পশু কুরবানী করাও ওয়াজিব নয়।
কোরবানির পশুর চামড়ার বিধান কি
কুরবানীর চামড়া যদি দান বা সদকা করে দিতে চাই তবে বিক্রি না করে দান বা সদকা করা সর্বোত্তম। যদি চামড়া বিক্রি করা হয় তবে সদকা করার নিয়তে চামড়া বিক্রি করা যায়। দান করার নিয়ত না করে বিক্রি করলে সেটি গুনাহের কারণ হয়ে যাবে। এজন্য পুরো চামড়া দান করে দেওয়া জরুরী।
কোরবানির ওষুধ চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে কোরবানি দাতা সেটি ব্যবহার করতে পারবে। প্রয়োজনে চামড়া প্রিয়জনকে উপহার দিতে পারবে । পশু কাটাকাটির যে আয়োজন করে অর্থাৎ পশুর গোশত চামড়া বা উপরে থাকা চাদর এগুলোর কোন কিছু কসাইকে দেওয়া যাবে না। ইসলামের শরীয়তে এটি নিষিদ্ধ রয়েছে।
চামড়া বিক্রির অর্থ যাদের দেওয়া যাবে
আমরা কোরবানির সাধারণত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য করে থাকি। এ সময় অনেকে মনে প্রশ্ন জাগে কোরবানির পশুর চামড়া কি করা উত্তম। কোরবানির পশুর চামড়া সাধারণত নিজের ব্যবহার করা সবচেয়ে উত্তম। তবে যদি এটি নিজের ব্যবহার না করে বিক্রি করে দেয়া হয় তবে সেই অর্থ নিজে ব্যবহার করা যাবে না।
এই অর্থের ওপর এতিমখানা বা দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের পুরোপুরি হক রয়েছে। যেখানে গরিব অসহায় ছাত্ররা পড়াশোনা করে। এছাড়াও যারা ফিতরা ও যাকাত পাওয়ার মতো উপযুক্ত শুধুমাত্র তারাই কোরবানির চামড়া অর্থ পাওয়ার অবদান রাখে। ইলমের দ্বিনের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে। ইলমে দ্বিনের দারিদ্র শিক্ষার্থীকে কোরবানির চামড়ার মূল্য ফিতরা ও যাকাত মূল্য প্রদানে বেশি সওয়াব রয়েছে।
ইসলামে পশু কোরবানির গুরুত্ব
কোরবানিতে আমরা অনেকেই কোরবানি করে থাকি। পবিত্র কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক এর নৈকট্য হাসিল করা যায় এবং পবিত্র কোরবানি দিয়ে অশেষ সওয়াব হাসিল করা যায়। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পশু জবাই নয়; জীবনের সর্বক্ষেত্রে খোদাভীতি ও প্রীতি অর্জনই মূল লক্ষ্য।কোরবানির বিনিময়ে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অসংখ্য পুরস্কার ও অফুরন্ত প্রতিদান পাওয়া যায়।
কুরবানী সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, " আমার কাছে পৌঁছায় না উহার (পশুর) কোন রক্ত বা মাংস শুধুমাত্র পৌঁছায় বান্দার তাকওয়া।" অর্থাৎ কুরবানী করার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে তাকওয়াবান করে। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যারা কোরবানি করবে হাশরের ময়দানে পুলসিরাত পার করতে সেই পশু তাকে সাহায্য করবে। কুরবানীকৃত পশুর পিঠে চড়ে ওই ব্যক্তি পুলসিরাত পার হবেন।
আরো পড়ুনঃ ব্যায়াম করার উপকারিতা ও অপকারিতা
তাই আমাদের উচিত লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানী করা। কেননা এই মহাবিশ্বের পরিচালনাকারী ও অসীম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ তা'লা। তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলেই আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হব।
লেখকের মন্তব্যㅣপশু কোরবানির প্রস্তু্তি ও করণীয়
আমরা যারা পশু কুরবানী করে থাকি, সকলকে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আমাদের পশু কোরবানি পরিপূর্ণভাবে সঠিক হয় এবং এর জবাই প্রক্রিয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেখানো সুন্নত তরিকায় হয়। আল্লাহ তাআলা সকল মুসলিমকে উল্লেখিত নিয়মে কোরবানি আদায় করার তওফিক দান করুন। সকলের কোরবানি কবুল করুন। আমিন।
প্রিয় পাঠক, আমাদের এই আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকলে কমেন্ট ও শেয়ার করতে ভুলবেন না। এরকম নিত্য নতুন আর্টিকেল পড়তে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি ভিজিট করতে পারেন। এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে আর্টিকেলটি করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনি আপনার মূল্যবান মন্তব্যটি এখানে লিখুন। প্রতিটি মন্তব্য গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।
comment url