শবে বরাতের আমল - শবে বরাতে করনীয় ও বর্জনীয়
শবে বরাত আমাদের নিকট অনেক বরকতময় একটি রাত। মূলত শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত নামে অভিহিত করা হয়। শবে বরাত কথাটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। যার শব অর্থ রাত এবং বরাত অর্থ মুক্তি। অর্থাৎ শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত বা মুক্তির রজনী। এই রাতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।
এই রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করতেন এবং পরদিন রোজা রাখতেন। এই রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করতেন এবং সিজদা অনেক লম্বা করতেন। এই রাতকে নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ি করা উচিত নয় তেমনি ছাড়াছাড়ি করা ও ঠিক নয়। কেননা এ রাতের ফজিলত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
এমন একটি নির্ভরযোগ্য হাদিস হলো- বিশিষ্ট সাহাবি মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহতালা এই দিন (অর্থাৎ ১৪ই শাবান দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সকলকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
এই আর্টিকেলে আমরা শবে বরাতের আমল ও এ রাতে আমাদের করণীয় বর্জনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাই এই সম্পর্কে জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। সেইসাথে এই ফজিলত পূর্ণ রাত যেন আমাদের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে সেই চেষ্টা করুন।
শবে বরাতের আমল
শবে বরাত হলো মুসলিম উম্মাহর নিকট খুবই মর্যাদাপূর্ণ একটি রাত। মূলত হিজরী শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে শবে বরাত পালন করা হয়। হাদিস শরীফে যাকে লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা অনেকেই এই রাতকে ভাগ্য রজনী বলে ভুল করে থাকি। আবার অনেকেই এই রাতে লাইলাতুল কদরের থেকেও বেশি ফজিলতপূর্ণ রাত মনে করি।
আবার অনেকে রয়েছে যারা মনে করেন এই রাতের কোন ফজিলত নেই। আমাদের এই দুই ধরনের ধারণায় ভুল। হাদিস শরীফে ফজিলত পূর্ণ যে পাঁচটি রাতের কথা উল্লেখ হয়েছে তার মধ্যে নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনী একটি। তবে এর তাৎপর্য লাইলাতুল কদরের তুলনায় কম।
শবে বরাতের রাতে আল্লাহতা'লা সকলকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। হাদীস শরীফে রয়েছে এই রাতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত অন্য সকলকেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই ফজিলত পূর্ণ রাতে আমরা যেসব আমল করতে পারি সেগুলো হলো-
রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া
নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করা যায়। শবে বরাতের ফজিলত পূর্ণ রাতের আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তাই বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া উচিত। এইসব নফল নামাজে নির্ধারিত কোন সূরা পড়ার কথা বলা নেই বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতই এই নামাজ পড়তে হয়। তবে এই নামাজে দীর্ঘ কেরাত পড়ার কথা উল্লেখ আছে। সেই সাথে রুকু ও সেজদায় বেশি সময় নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে একটি হাদিস হলো-
আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে ঘুম থেকে উঠে নামাজে দাঁড়ালেন এবং সেই নামাজে তিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে সিজদায় ছিলেন যে আমার মনে চিন্তা হচ্ছিল তিনি ইন্তেকাল করলেন কিনা? আমি তখন তার বৃদ্ধাঙ্গুলের নাড়া দিলাম। তিনি তখন আঙ্গুলটি নাড়ালেন। ফলে আমি নিশ্চিত হলাম তিনি জীবিত রয়েছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজ শেষ করে আমাকে বললেন-" হে আয়েশা তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি তখন যেভাবে বললাম, না, হে আল্লাহর রাসূল। আপনার দীর্ঘ সিজদা করা দেখে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা? তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি তখন বললাম আল্লাহ এবং তার রাসূলই ভালো জানেন। তখন তিনি এরশাদ করলেন এটা হলো লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনী। এই রজনীতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর যারা মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী তাদেরকে তিনি তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ঈমান, হাদিসঃ ৩৫৫৪)
এই হাদিস দ্বারা এটিই প্রতিয়মান হয় যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) এ রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করতেন এবং দীর্ঘ সিজদা করতেন।
বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করা
আমরা প্রতিনিয়ত গুনাহ করতে থাকি। আর এই গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তওবার মাধ্যমে। এ রাতে আল্লাহ তাআলা যেহেতু বান্দার সবচেয়ে নিকটবর্তী হন তাই এই রাতে বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার পাঠ করা উচিত। বান্দা তার গুনাহের কথা স্মরণ করে সঠিক পথে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারেন। এর ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন।
হাদীস শরীফে এসেছে, হজরত ওসমান ইবনে আবিল আস (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি এই রাতে অর্থাৎ লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনীতে আল্লাহতালা তার বান্দাদেরকে বলেন তোমাদের মধ্যে কেউ কি আছে ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। আছে কি এমন কেউ যার কিছু চাইবার আছে? আমি তার চাহিদা পূরণ করে দিব। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এই দিন মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সমস্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তাদের চাওয়া পাওয়া পূরণ করা হয়। (ইবনে মাজাহ, হাদিসঃ ১৩৮৮)
এছাড়াও রাতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। নবীজি (সা.) বলেন, এ রাতে আল্লাহ তাআলা বনু কালবের ছাগলগুলোর পশমের চেয়েও অধিকসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিসঃ ১৩৮৯)
দোয়া প্রার্থনা করা
লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনীতে আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের দোয়া কবুল করেন। হাদীস শরীফে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, পাঁচটি এমন রাত রয়েছে যে রাতে বান্দার কোন দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। সেগুলো হলো জুমআর রাতের দোয়া, ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া, ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদের রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া এবং লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনীর দোয়া। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
এছাড়াও ইমাম শাফি (রা.) তার কিতাবুল উম্ম, আস-সুনানুল কুবরা কিতাবের মধ্যে উল্লেখ করেছেন, আমাদের নিকট পৌঁছেছে যে, পাঁচটি রাতের দোয়া বেশি বেশি কবুল করা হয়। এগুলো হলো জুমআর রাতের দোয়া, ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া, ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদের রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া এবং লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনীর দোয়া।
সাওম পালন করা
আমাদের সমাজে শবে বরাতের রোজা রাখা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মদ চালু রয়েছে। এ সম্পর্কে কাতার ইউনিভার্সিটি শরিয়াহ বিষয়ের প্রধান শায়খ নুরুদ্দীন আল খাদেমী বলেছেন, এই দিনকে কেন্দ্র করে রোজা পালন আবশ্যক মনে করা বিতর্কিত বিষয়। তবে কেউ যদি এটিকে আইয়ামে বীজের অন্তর্ভুক্ত করে তবে সেক্ষেত্রে সে রোজা রাখতে পারবে। আইয়ামে বীজ হচ্ছে প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ। এই তিন দিন রোজা রাখা অতি উত্তম যার সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
এর পাশাপাশি তিনি আরো বলেন নবী করিম (সা.) রমজানের প্রস্তুতি স্বরূপ শাবান মাসের বেশি বেশি নফল রোজা পালন করতেন। সেই সুবাদে শবে বরাতের রোজাকে শাবান মাসের সুন্নত রোজার অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এ সম্পর্কিত একটি হাদিস হলো- আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে শাবান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে এত বেশি সাওম পালন করতে দেখিনি।
এছাড়াও অন্য একটি হাদিসে রয়েছে-হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ১৫ই শাবানের রাত অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করো এবং পরের দিন রোজা রাখো। (ইবনে মাজাহ)
তবে এই হাদিসটি জঈফ হওয়ার কারণে অনেকেই উপরে উল্লেখিত অভিমত গুলো ব্যক্ত করেছেন। তবে বেশিরভাগ আলেমগণ হাদীসটিকে আমল করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেছেন। কেননা হাদিস বিশারদদের মতে, ফজিলতপূর্ণ যেকোনো জঈফ হাদীসও গ্রহণযোগ্য। তাই শবে বরাতের রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করতে হবে এবং পরদিন সম্ভব হলে রোজা রাখার চেষ্টা করতে হবে।
এছাড়াও আপনি চাইলে এই রাতে আরও বিভিন্ন ধরনের আমল করতে পারেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করা
- জিকির আজগার করা
- তাসবিহ তাহলিল পড়া
- নবীজি (সা.) এর উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা
- নিজের জীবনের গুনাহ গুলো স্মরণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করা
- আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ কামনা করা
- পরদিন রোজা রাখা
আপনি চাইলে এই সব আমলগুলো করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন এমনটি যেন না হয় যে রাত জেগে ইবাদত করার জন্য পরের দিন ফজরের সালাত মিস হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে শাবান মাসের মধ্য রজনীতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করার তৌফিক দান করুন।
শবে বরাতে আমাদের করণীয়
আমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন শবেবরাতের রাতে পরবর্তী এক বছরের ভালো মন্দ সকল কিছু হিসাব-নিকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে তারা সূরা দুখান এর ১-৪ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। সেখানে আল্লাহ তা'আলা বলেন- "হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তার নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে নিশ্চয়ই আমি দ্রুত পাঠিয়ে থাকি।"(সূরা দুখানঃ ১-৪)
তবে তাফসিরবিদগণ এই রাতকে শবে বরাতের রাত নয় বরং শবে কদরের রাত বলে উল্লেখ করেন। এক্ষেত্রে তারা সূরা আল কদরের প্রথম আয়াত তুলে ধরেন। সেখানে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন- "নিশ্চয়ই আমি এটি নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে।"(সূরা আল কদরঃ ১)। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি সৃষ্টি জগতের ভাগ্য নির্ধারণ হয় শবে কদরের রাতে।
তবে শবে বরাতের যে অনেক ফজিলত রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, পাঁচটি এমন রাত রয়েছে যে রাতে বান্দার কোন দোয়া ফেরত দেওয়া হয় না। সেগুলো হলো জুমআর রাতের দোয়া, ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া, ঈদুল আযহা বা কুরবানীর ঈদের রাতের দোয়া, রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া এবং লাইলাতুন নিসফা মিন শাবান অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্য রজনীর দোয়া। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
এছাড়াও এই রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে নেমে আসেন। এবং তিনি তার বান্দাদের ডেকে ডেকে বলতে থাকেন এমন কি কেউ আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? তাকে আমি ক্ষমা করে দিব। এমন কি কেউ আছো যে আমার কাছে সাহায্য চাইবে? তাকে আমি সাহায্য করবো। তাই এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য চাইতে হবে।
এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। শুধুমাত্র দুই শ্রেণীর মানুষ ব্যতীত যারা মুশরিক ও যারা হিংসুক। এজন্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টের জন্য এবং জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করার জন্য আমাদের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। যেগুলো হলো-
- বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা। অন্যান্য নফল নামাজের মতই নামাজ পড়া। যদি সম্ভব হয় নামাজের বেশি বেশি আয়াতুল কুরসি পাঠ করা।
- যেহেতু এই রাত অনেক ফজিলত পূর্ণ রাত। তাই এ রাতে বেশি বেশি কোরআন তেলোয়াত করা উত্তম।
- শবে বরাতের রাতে যে সকল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় তার মধ্যে জিকির আজগার অন্যতম। তাই এই রাতে বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা।
- এই রাত অনেক ফজিলতপূর্ণ রাত হওয়ার কারণে এ রাতে সালাতুত তাসবিহ নামাজ আদায় করা। সেই সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তা পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
- আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমাপ্রার্থনা করা। পুরনো পাপের কথা চিন্তা করে ইস্তেগফার পাঠ করা এবং ভবিষ্যতে সেগুলো না করার জন্য অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়া।
- এই রাতে কবর জিয়ারত করা উত্তম। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে- হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে হারিয়ে ফেললাম। অতঃপর খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে তাকে জান্নাতুল বাকিতে পেলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, আয়েশা তুমি কি আশঙ্কা করেছ? আল্লাহর রাসূল আমার প্রতি জুলুম করবেন? হযরত আয়েশা বলেন-আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আজকের এই রাতে অর্থাৎ ১৫ শাবান রাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং তিনি বনু কালবের ছাগলগুলোর পশমের চেয়েও অধিকসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিসঃ ১৩৮৯)
- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা।
- নিজের জন্য, পিতা মাতার জন্য, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সহ সকল মুমিন-মুমিনাতের জন্য দোয়া করা এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করা। দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করা।
- সেই সাথে একটি দোয়া বেশি বেশি পাঠ করা। সেটি হলো- আল্লাহম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি। অর্থঃ হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা পছন্দ করো, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও।
- সারারাত ইবাদত বন্দেগী করে পরের দিন রোজা রাখা। একটি হাদিসে রয়েছে-হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ১৫ই শাবানের রাত অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করো এবং পরের দিন রোজা রাখো। (ইবনে মাজাহ)
তবে এ রাতে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সারারাত নফল ইবাদত করার ফলে জামাআতে ফজরের সালাত ছুটে না যায়। কেননা ফজরের সালাত ছুটে গেলে সারারাতের সমস্ত ইবাদতের তাৎপর্য ম্লান হয়ে যায়। এছাড়াও আপনি যদি শিরক ও হিংসা থেকে বিরত থাকতে পারেন তবে আপনি সারা রাত ইবাদত না করলেও আল্লাহর সাধারণ ক্ষমার ভিতরে থেকে যাবেন। তাই এই দিন জামাআতের সাথে এশার ও ফজরের সালাত আদায় করতে হবে।
শবে বরাতের রাতে বর্জনীয় কাজ
শবে বরাতের রাতে আমাদের যেমন কিছু করণীয় কাজ রয়েছে তেমনি কিছু বর্জনীয় কাজ ও রয়েছে। এই রাতে আমাদের যেসব কাজ করা উচিত নয় সেগুলো হলো-
- আতশবাজি বা পটকা ফোটানো।
- অযথা কথাবার্তা বলা ও অশালীন আচরণ করা।
- অন্য কারো ইবাদতের বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো।
- হালুয়া রুটির জন্য সময় নষ্ট করা।
- ইবাদত বন্দেগী না করে অযথা সময় নষ্ট করা।
- সমাজ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু করা।
- মসজিদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
- মসজিদ বাসা বাড়ি আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো।
- ইবাদত বন্দেগীর জন্য দলে দলে মানুষ জামাতবদ্ধ হওয়া।
- আল্লাহর সন্তুষ্ট লাভের আশায় গরু খাসি জবাই করে মানুষ জনদের খাওয়ানো।
শবে বরাত কি বিদআত
শবে বরাতের অনেক ফজিলত রয়েছে। তবে তা অবশ্যই লাইলাতুল কদরের তুলনায় কম। আমরা অনেকেরই একে লাইলাতুল কদরের চেয়েও অধিক মর্যাদাপূর্ণ রাত মনে করি যা বিদআত। আবার অনেকে এই রাতের গুরুত্ব অনুভব করি না যা গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহতালা যে পাঁচটি রাতে বান্দার দোয়া বেশি বেশি কবুল করেন তার মধ্যে একটি হলো শবে বরাত।
তবে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বেশ কিছু বিদআত চালু রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই দিন হালুয়া রুটি খাওয়া, মসজিদে জামাতবদ্ধ ভাবে ইবাদত করা, বাসা বাড়ি আলোকসজ্জা দিয়ে সাজানো ইত্যাদি। এসব আচার অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এবাদত বন্দি করলে তা থেকে আল্লাহ তাআলা উত্তম প্রতিদান দান করবেন।
সুতরাং আমরা বলতে পারি শবে বরাত পালন করা বিদআত নয় বরং আমাদের সংস্কৃতিতে এই রাতকে যেভাবে উদযাপন করা হয় তাতে কিছু বিদআত যুক্ত হয়েছে। এগুলো বাদ দিয়ে শবে বরাতের রাত ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে পালন করলে তা থেকে সফলকাম হওয়া যায়। তোমাদের প্রিয় নবী (সা.) এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত করতেন।
শবে বরাত পালন করা কি জায়েজ
প্রিয় বন্ধুগণ, আপনি যদি আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ে থাকেন তবে আপনি অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন শবেবরাতের অনেক ফজিলত রয়েছে। এ কারণেই এটি পালন করা জায়েজ। আপনি যদি একজন প্রকৃত মুসলিম হয়ে থাকেন তবে আপনি কখনোই শবে বরাত কে অস্বীকার করতে পারবেন না। কেননা এই রাতে আল্লাহতালা দুই শ্রেণীর মানুষ ব্যতীত সকলকেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
তাই এই ফজিলতপূর্ণ রাতে আমাদের উচিত বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করা। সেইসাথে শিরক ও হিংসা মুক্ত জীবন গড়ে তোলা। কেননা যাদের মনের মধ্যে হিংসা ও শিরক রয়েছে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা এই ফজিলতপূর্ণ রাতেও ক্ষমা করেন না। সেই সাথে এই রাতে যেসব বিদআত পালন করা হয় সেগুলো থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
শবে বরাতের রোজা পালনের নিয়ম - শবে বরাতের কয়টি রোজা করতে হয়
শবে বরাতের রোজা সম্পর্কে হাদিস শরীফে ও কুরআন মাজীদে তেমন কিছু উল্লেখ নেই। তবে কেউ যদি এটিকে আইয়ামে বীজের অন্তর্ভুক্ত করে রোজা রাখেন তবে তা বৈধ হবে। আইয়ামে বীজ হলো প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। এই তিন দিন রোজা রাখা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এছাড়াও নবী করিম (সা.) রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন।
এ সম্পর্কিত একটি হাদিস হলো- আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে শাবান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে এত বেশি সাওম পালন করতে দেখিনি।
একটি হাদিসে রয়েছে- হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ১৫ই শাবানের রাত অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করো এবং পরের দিন রোজা রাখো। (ইবনে মাজাহ)
এছাড়াও অন্য একটি হাদিস শরীফে রয়েছে- ’ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (সা.) তাকে অথবা অপর কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি শাবান মাসের মধ্যভাগে সওম পালন করেছিলে? তিনি বললেন, না। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তুমি সওম পালন করনি, তখন দুইদিন সওম পালন করে নিও। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২৬১৮, ইসলামীক সেন্টার ২৬১৭)
এছাড়া অন্য একটা হাদিসে রয়েছে- আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) পুরো শাবান মাসের কিছু অংশ ছাড়া সমস্ত মাস ধরেই রোজা রাখতেন। (সহিহ বুখারী-১৯৭০ ও সহিহ মুসলিম-১১৫৬)
আরো পড়ুনঃ রোজা থাকা অবস্থায় ফরজ গোসলের নিয়ম
এই আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে আপনি যদি চান রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতে পারেন। সেই সাথে আপনি ১৫ই শাবান একটি রোজা রাখতে পারেন। তবে এই মাসে বেশি বেশি রোজা পালন করাই উত্তম। এতে করে একটি সুন্নত পালন করা হয়।
লেখক এর মন্তব্য
আপনি যদি আর্টিকেলটি সম্পন্ন করে থাকেন তবে অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন শবে বরাতের অনেক ফজিলত রয়েছে। তবে এটিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন অবকাশ নেই আবার এটিকে বাদ দেওয়া ও ঠিক হবে না। আপনার মধ্যে যদি শিরক ও হিংসা না থাকে তবে আপনি এই রাতের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবেন না। তাই আমাদের উচিত শিরক ও হিংসামুক্ত জীবন গড়ে তোলা।
প্রিয় পাঠক, আজকের এই আর্টিকেল পরে আমরা শবে বরাতের আমল ও এই রাতে আমাদের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। আশা করি আপনারা এর সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। এ সম্পর্কে যদি আপনার কোন জিজ্ঞাসা থাকে তবে আপনি কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। এছাড়াও আমাদের আজকের আর্টিকেল পড়ে আপনার কাছে কেমন লেগেছে সেই সম্পর্কে আপনার মূল্যবান বক্তব্য কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানান।
আপনি আপনার মূল্যবান মন্তব্যটি এখানে লিখুন। প্রতিটি মন্তব্য গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়।
comment url